ঢাকা ০২:২৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ০৮ অগাস্ট ২০২৫, ২৩ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সাংবাদিকদের নিরাপত্তা কোথায়? বিএমএসএফ-এর ক্ষোভ ও রাষ্ট্রের দায়

গাজিপুর প্রতিনিধি
  • প্রকাশের সময়: ১০:৪১:৫৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৭ অগাস্ট ২০২৫ ৪২ জন পড়েছে

২৪ ঘন্টার ব্যবধানে গাজিপুরে এক সাংবাদিককে গুরুতর আহত এবং অপর একজনকে হ্যা

গাজীপুরে নৃশংসভাবে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ পত্রিকার চিফ রিপোর্টার মো. আসাদুজ্জামান তুহিনকে (৩৮)। বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) রাত পৌনে ৮টার দিকে চান্দনা চৌরাস্তা মসজিদ মার্কেটের সামনে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার সময় তিনি এক চায়ের দোকানে বসে ছিলেন।

এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে সাংবাদিক সংগঠন বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরাম (বিএমএসএফ)। সংগঠনটি রাষ্ট্রযন্ত্রের নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করে দোষীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করেছে।

সাংবাদিক হত্যা: এক দিনের ব্যবধানে দুটি হামলা

তুহিন হত্যাকাণ্ডের একদিন আগেই, একই গাজীপুরে সাংবাদিকদের ওপর আরেকটি ভয়াবহ হামলার ঘটনা ঘটে। বুধবার থানার সামনে প্রকাশ্যে ইট দিয়ে মাথায় আঘাত করে গুরুতর আহত করা হয় বাংলাদেশের আলো পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেনকে।

এর মাত্র একদিনের ব্যবধানে ঘটা তুহিন হত্যাকাণ্ডে গোটা সাংবাদিক সমাজ স্তম্ভিত।

চায়ের দোকানে বসে থাকা অবস্থায় ঘিরে ধরে হত্যাকাণ্ড

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নিহত সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন চান্দনা চৌরাস্তা এলাকার ফুটপাত ও দোকানপাটে চাঁদাবাজি নিয়ে বৃহস্পতিবার বিকেলে একটি লাইভ সম্প্রচার করেন। সেই ভিডিও নিজের ফেসবুকেও পোস্ট করে লেখেন-“যেমন খুশি তেমন রাস্তা পার হওয়ার দৃশ্য। গাজীপুর চৌরাস্তা।”

লাইভের কিছু সময় পর, রাত পৌনে ৮টার দিকে তিনি মসজিদ মার্কেটের সামনে একটি চায়ের দোকানে বসে ছিলেন। সেসময় কয়েকজন সন্ত্রাসী তাকে ঘিরে ধরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। কুপিয়ে জবাই করে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে তারা পালিয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের সামনে এমন হত্যাকাণ্ডে গোটা এলাকায় চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

পরিবার ও পেশাগত পরিচয়

মো. আসাদুজ্জামান তুহিন ছিলেন ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া থানার ভাটিপাড়া গ্রামের সন্তান। গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন তিনি। তিনি দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ-এর গাজীপুর প্রতিনিধি হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন এবং স্থানীয় নানা অসঙ্গতি নিয়ে সরব ভূমিকা পালন করে আসছিলেন।

পুলিশের বক্তব্য

ঘটনার বিষয়ে বাসন থানার ওসি শাহীন খান বলেন,
“খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠায়। কী কারণে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”

তিনি আরও জানান, জড়িতদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

রাষ্ট্রের দায় ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা প্রশ্নে বিস্ময় বিএমএসএফ-এর

এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে বিএমএসএফ। সংগঠনটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আহমেদ আবু জাফর বলেন-

“সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রাষ্ট্রযন্ত্রের নিষ্ক্রিয়তা প্রমাণ করে দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা চরম হুমকির মুখে পড়েছে। আমরা তুহিন হত্যার ঘটনায় জড়িতদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার করে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানাই।”

তিনি আরও বলেন,
“সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হবে।”

সাংবাদিকদের ওপর ধারাবাহিক হামলা: নাকি একটি বার্তা?

দেশের বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিকদের ওপর যেভাবে একের পর এক হামলা হচ্ছে, তা শুধুই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সামাজিক দুর্নীতি, চাঁদাবাজি কিংবা প্রভাবশালী মহলের অপরাধ প্রকাশে সাংবাদিকদের ভূমিকা অনেক সময় তাদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে দেয়।

তুহিন হত্যাকাণ্ডকে নিছক ‘স্থানীয় দ্বন্দ্ব’ বলে পাশ কাটানোর সুযোগ নেই। তিনি যে ভিডিও লাইভ ও পোস্ট করেছিলেন, তা ছিল সংশ্লিষ্ট এলাকার চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধেই। প্রশ্ন উঠছে-এই ভিডিওর পরপরই তাকে কেন টার্গেট করা হলো?

তদন্ত ও বিচার: সময়ের দাবি

সাংবাদিক সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো একসুরে দাবি তুলেছে-তুহিন হত্যার পেছনে কারা জড়িত, কী উদ্দেশ্যে হত্যা করা হলো, তা দ্রুত উদঘাটন করে দোষীদের আইনের আওতায় আনতে হবে।

এ হত্যাকাণ্ড শুধু একজন সাংবাদিকের মৃত্যু নয়-এটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত। তদন্ত ও বিচার যদি বিলম্বিত হয়, তবে তা হবে সাংবাদিক সমাজের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতার প্রমাণ।

নিউজটি শেয়ার করে সকলকে জানিয়ে দিন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

সাংবাদিকদের নিরাপত্তা কোথায়? বিএমএসএফ-এর ক্ষোভ ও রাষ্ট্রের দায়

প্রকাশের সময়: ১০:৪১:৫৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৭ অগাস্ট ২০২৫

গাজীপুরে নৃশংসভাবে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ পত্রিকার চিফ রিপোর্টার মো. আসাদুজ্জামান তুহিনকে (৩৮)। বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) রাত পৌনে ৮টার দিকে চান্দনা চৌরাস্তা মসজিদ মার্কেটের সামনে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার সময় তিনি এক চায়ের দোকানে বসে ছিলেন।

এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে সাংবাদিক সংগঠন বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরাম (বিএমএসএফ)। সংগঠনটি রাষ্ট্রযন্ত্রের নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করে দোষীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করেছে।

সাংবাদিক হত্যা: এক দিনের ব্যবধানে দুটি হামলা

তুহিন হত্যাকাণ্ডের একদিন আগেই, একই গাজীপুরে সাংবাদিকদের ওপর আরেকটি ভয়াবহ হামলার ঘটনা ঘটে। বুধবার থানার সামনে প্রকাশ্যে ইট দিয়ে মাথায় আঘাত করে গুরুতর আহত করা হয় বাংলাদেশের আলো পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেনকে।

এর মাত্র একদিনের ব্যবধানে ঘটা তুহিন হত্যাকাণ্ডে গোটা সাংবাদিক সমাজ স্তম্ভিত।

চায়ের দোকানে বসে থাকা অবস্থায় ঘিরে ধরে হত্যাকাণ্ড

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নিহত সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন চান্দনা চৌরাস্তা এলাকার ফুটপাত ও দোকানপাটে চাঁদাবাজি নিয়ে বৃহস্পতিবার বিকেলে একটি লাইভ সম্প্রচার করেন। সেই ভিডিও নিজের ফেসবুকেও পোস্ট করে লেখেন-“যেমন খুশি তেমন রাস্তা পার হওয়ার দৃশ্য। গাজীপুর চৌরাস্তা।”

লাইভের কিছু সময় পর, রাত পৌনে ৮টার দিকে তিনি মসজিদ মার্কেটের সামনে একটি চায়ের দোকানে বসে ছিলেন। সেসময় কয়েকজন সন্ত্রাসী তাকে ঘিরে ধরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। কুপিয়ে জবাই করে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে তারা পালিয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের সামনে এমন হত্যাকাণ্ডে গোটা এলাকায় চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

পরিবার ও পেশাগত পরিচয়

মো. আসাদুজ্জামান তুহিন ছিলেন ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া থানার ভাটিপাড়া গ্রামের সন্তান। গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন তিনি। তিনি দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ-এর গাজীপুর প্রতিনিধি হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন এবং স্থানীয় নানা অসঙ্গতি নিয়ে সরব ভূমিকা পালন করে আসছিলেন।

পুলিশের বক্তব্য

ঘটনার বিষয়ে বাসন থানার ওসি শাহীন খান বলেন,
“খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠায়। কী কারণে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”

তিনি আরও জানান, জড়িতদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

রাষ্ট্রের দায় ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা প্রশ্নে বিস্ময় বিএমএসএফ-এর

এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে বিএমএসএফ। সংগঠনটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আহমেদ আবু জাফর বলেন-

“সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রাষ্ট্রযন্ত্রের নিষ্ক্রিয়তা প্রমাণ করে দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা চরম হুমকির মুখে পড়েছে। আমরা তুহিন হত্যার ঘটনায় জড়িতদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার করে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানাই।”

তিনি আরও বলেন,
“সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হবে।”

সাংবাদিকদের ওপর ধারাবাহিক হামলা: নাকি একটি বার্তা?

দেশের বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিকদের ওপর যেভাবে একের পর এক হামলা হচ্ছে, তা শুধুই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সামাজিক দুর্নীতি, চাঁদাবাজি কিংবা প্রভাবশালী মহলের অপরাধ প্রকাশে সাংবাদিকদের ভূমিকা অনেক সময় তাদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে দেয়।

তুহিন হত্যাকাণ্ডকে নিছক ‘স্থানীয় দ্বন্দ্ব’ বলে পাশ কাটানোর সুযোগ নেই। তিনি যে ভিডিও লাইভ ও পোস্ট করেছিলেন, তা ছিল সংশ্লিষ্ট এলাকার চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধেই। প্রশ্ন উঠছে-এই ভিডিওর পরপরই তাকে কেন টার্গেট করা হলো?

তদন্ত ও বিচার: সময়ের দাবি

সাংবাদিক সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো একসুরে দাবি তুলেছে-তুহিন হত্যার পেছনে কারা জড়িত, কী উদ্দেশ্যে হত্যা করা হলো, তা দ্রুত উদঘাটন করে দোষীদের আইনের আওতায় আনতে হবে।

এ হত্যাকাণ্ড শুধু একজন সাংবাদিকের মৃত্যু নয়-এটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত। তদন্ত ও বিচার যদি বিলম্বিত হয়, তবে তা হবে সাংবাদিক সমাজের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতার প্রমাণ।