বগুড়ায় বাগানে বাগানে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে বিদেশি জারবেরা

- প্রকাশের সময়: ১০:০৫:১৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮৮ জন পড়েছে
লাল, সাদা, হলুদ, পিংক, মেজেন্টা, কমলা, রানী গোলাপি বা জাম রঙের জারবেরা ফুলের যেন এক রঙিন খেলা চলছে পুরো মাঠজুড়ে। শীতের কোমল হাওয়ার সাথে ফুলের সুবাস ও শোভা মুগ্ধতার সৃষ্টি করছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, যেন কোনও চিত্রশিল্পী রং তুলিতে মনের খেয়ালে এই ফুলগুলো আঁকছেন।
রঙিন জারবেরা চাষ করে নিজের জীবন ও সংসারের জীবনে রঙিনতার ছোঁয়া এনেছেন ফুল চাষী আফছার আলী। মাত্র দুই বছরে ৮ লাখ টাকা লগ্নি করেছেন এই চাষে। এর মধ্যে তিনি বিক্রি করেছেন ৩০ লাখ টাকার ফুল।
সদর উপজেলার সাবগ্রাম ইউনিয়নের গোবরধনপুর গ্রামের আফছার আলী ২০২২ সালে বাণিজ্যিকভাবে জারবেরা ফুল চাষ শুরু করেন। পড়ালেখা শেষ করে চাকরির পিছনে না ছুটে, তিনি ফুল চাষের দিকে মনোনিবেশ করেন এবং দুই বছরের মধ্যেই সফলতা অর্জন করেন।
জারবেরা ফুল অ্যাসটারেসি পরিবারভুক্ত একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ও উচ্চমূল্যের বাণিজ্যিক ফুল। জার্মান পরিবেশবিদ ট্রগোট জার্বারের নামানুসারে এ ফুলটির নামকরণ করা হয়েছে।
এটি আন্তর্জাতিক ফুল বাণিজ্যে কাট ফ্লাওয়ার হিসেবে উল্লেখযোগ্য ১০টি ফুলের মধ্যে একটি। কাট ফ্লাওয়ার হিসেবে, বিশেষ করে ফুলদানীতে দীর্ঘদিন সতেজ রাখা যায় এমন ফুলের মধ্যে জারবেরার জুড়ি নেই। এর গুণাবলী এবং দীর্ঘস্থায়ী শোভা, জারবেরাকে ফুল প্রেমীদের কাছে বিশেষভাবে জনপ্রিয় করে তুলেছে।
জারবেরা ফুলের বংশবৃদ্ধি বীজের মাধ্যমে করা যায়, তবে এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত গাছের মধ্যে মাতৃগাছের সকল গুনাবলী বজায় থাকে না। তবে, বীজের মাধ্যমে চাষ করা সহজ এবং এ পদ্ধতির একটি বড় সুবিধা হলো রোগ-পোকা আক্রমণের আশঙ্কা কম থাকে।
আফছার আলী তার এক বিঘা জমিতে টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে জারবেরা ফুল চাষ শুরু করেন। তার বাগান, পলিনেট হাউজে, লাল, সাদা, হলুদ, পিংক, মেজেন্টা, কমলা, রানী গোলাপি এবং জাম রঙের জারবেরা ফুলের শোভা ফুটে উঠেছে। ভারতের পুনে থেকে বিভিন্ন জাতের জারবেরা ফুল সংগ্রহ করে তিনি চাষ শুরু করেন। মাত্র তিন মাসের মধ্যেই চারা রোপণের পর প্রথম সফলতা পান তিনি।
দুই বছরের মধ্যে ৮ লাখ টাকা লগ্নি করে তিনি প্রায় ৩০ লাখ টাকার ফুল বিক্রি করেছেন। এছাড়া, গোলাপ চাষেও তিনি সফলতা পেয়েছেন এবং থাই গোলাপের বাগান তৈরি করেছেন।
ফুল চাষের মাধ্যমে আফছার আলী এখন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত এবং ফুল বিক্রি করে তিনি দেশের বিভিন্ন স্থান, যেমন রাজশাহী, রংপুর বিভাগ এবং ঢাকা শহরে ব্যবসা করছেন। বাণিজ্যিকভাবে জারবেরা চাষে এখন তিনি লাভের মুখ দেখছেন এবং সফলতার পথে এগিয়ে যাচ্ছেন।
ফুল চাষী আফছার আলীর বাগান পরিদর্শন করলে দেখা যায়, তার পলিনেট হাউজে বাহারি রঙের জারবেরা ফুল ফুটে রয়েছে। রঙ অনুযায়ী চারাগুলো আলাদা আলাদা সারিতে রোপণ করা হয়েছে, যা বাগানটির সৌন্দর্য আরও বাড়িয়েছে। যদিও জারবেরা চাষে খরচ বেশি, তবে এর লাভও অনেক বেশি। খরচের প্রধান কারণ হলো, বাগানের উপরে পলিশেড তৈরি করা, যার জন্য প্রায় ৬ লাখ টাকা খরচ হয়। তবে একবার শেড তৈরি করলে সেটি ৫ থেকে ৬ বছর পর্যন্ত ব্যবহারের উপযোগী থাকে।
এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সরকারিভাবে আফছার আলীকে শেড তৈরি করে দিয়েছে, যার ফলে তার চাষের খরচ অনেক কমে গেছে।
ফুলচাষীরা জানান, জারবেরা চারা লাগানোর পর ৯০ দিনের মধ্যেই ফুল দেখা শুরু হয়। প্রতিদিন বাগান থেকে দুইশ থেকে আড়াইশ ফুল তোলা সম্ভব। ফুলের দাম পাইকারি বাজারে ১২ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। তবে, জারবেরা গাছের পরিচর্যা বেশি করতে হয় কারণ গাছটি পচন রোগের প্রতি সংবেদনশীল। জারবেরা ফুল গাছ থেকে তোলার পর ১০ থেকে ১৫ দিন এবং গাছে ফোটা অবস্থায় ৩০ থেকে ৪৫ দিন পর্যন্ত সতেজ থাকে। এর ফলে, জারবেরা ফুলের চাহিদা অনেক বেশি।
উদ্যোক্তা আফছার আলী জানান, জারবেরা ফুল সারা বছরই ফোটে, তবে এপ্রিল-মে মাসে এর ভরা মৌসুম। এই ফুল সব ধরনের জলবায়ুতে বেঁচে থাকতে সক্ষম, তবে উজ্জ্বল রোদের সঙ্গে এর সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে শীত ও শীতের শেষ ভাগে জারবেরা ফুল ভালো হয়। পলিশেডে চাষ করলে সারা বছরই ভালো ফলন পাওয়া যায়। একটি জারবেরা ফুল গাছের গড় আয়ু প্রায় চার বছর এবং সঠিক পরিচর্যা করলে একটি গাছ থেকে বছরে ৮০ থেকে ৯০টি ফুল পাওয়া যায়।
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ফরিদুর রহমান ফরিদ বলেন, “উচ্চমূল্যের এ ফুল চাষে চাষীদের প্রশিক্ষণসহ সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে। বগুড়া জেলা ফুল চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী আবহাওয়া ও মাটি রয়েছে। জারবেরা ফুল চাষে চাষীদের ভাগ্য বদলেছে। আমরা অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি ফুলচাষে কৃষকদের উৎসাহিত করছি। বর্তমানে বগুড়ার সদর, শিবগঞ্জ, শাজাহানপুর এবং শেরপুর উপজেলায় কৃষকরা বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ করছেন।”