ইট তৈরির ভাটাগুলো গ্রাস করছে গাছপালা ও ফসলী জমি

- প্রকাশের সময়: ১০:০২:২৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৬০ জন পড়েছে
আমতলী উপজেলার কুকুয়া ইউনিয়নের রায়বালা ও খাগদান নামের দুটি গ্রামে অবৈধভাবে চারটি ইটভাটা গড়ে উঠেছে। ইটভাটাগুলোর মাত্র ১০০ ফুটের মধ্যে রয়েছে চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। চারপাশে রয়েছে ঘন জনবসতি এবং তিন ফসলি জমি। দীর্ঘদিন ধরে এ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ইট পোড়ানোর কাজ অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ফসলের উৎপাদন কমে যাচ্ছে এবং স্থানীয় বাসিন্দারা শ্বাসকষ্টসহ নানা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ভুগছেন।
গ্রাম দুটি ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় এখানকার বাসিন্দাদের জীবনযাত্রা ক্রমেই দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। এলাকাটির ৫০০ মিটারের মধ্যেই রয়েছে চারটি ইটভাটা: নূরজামালের আল্লাহর দান ব্রিকস, মাহবুবুল আলম মৃধার এসএম ব্রিকস, হান্নান মৃধার বিবিসি ব্রিকস, এবং শানু হাওলাদারের ফাইভ ব্রিকস।
আমতলীর রায়বালা ও খাগদান গ্রামে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটাগুলোর মধ্যে রয়েছে স্টার ব্রিকস। এসব ভাটা থেকে মাত্র ১০০ থেকে ১৫০ ফুট দূরত্বে রয়েছে রায়বালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আকবরিয়া দাখিল মাদ্রাসা, খাগদান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও খাগদান নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
অবৈধ ইটভাটা পরিচালনা প্রসঙ্গে রায়বালা গ্রামের বিবিসি ব্রিকসের মালিক মো. হান্নান মৃধার সঙ্গে কথা বললে তিনি দাবি করেন, “সবকিছু ম্যানেজ করেই ভাটার কার্যক্রম চলছে।” অন্যদিকে, ইট পরিবহনের কারণে রাস্তাঘাট নষ্ট হওয়ার বিষয়ে খাগদান গ্রামের ফাইভ স্টার ব্রিকসের মালিক শানু হাওলাদার সাফ জানিয়ে দেন, “রাস্তাঘাট ধ্বংস হলে আমার কিছু যায় আসে না।” সাংবাদিকদের উপস্থিতির খবর পেয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান আল্লাহর দান ইটভাটার মালিক নূরজামাল মৃধা। তাঁকে একাধিকবার ফোন করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গ্রাম দুটিতে ইটভাটার কর্মযজ্ঞ নিরন্তর চলছে। ভাটার মাত্র ৫-১০ ফুট দূরেই রয়েছে আমন ধানের ক্ষেত। ফসলের আধাপাকা ধানগুলো বিবর্ণ হয়ে গেছে। আশপাশের গাছপালা ও ঘরবাড়ি ধুলাবালিতে আচ্ছাদিত। প্রতিদিন শতাধিক ট্রলিতে ভাটায় ব্যবহারের জন্য মাটি ও পোড়া ইট পরিবহন করা হচ্ছে, যার কারণে মহিষকাটা থেকে হাজার টাকার বাঁধ পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার রাস্তা চষা জমিতে পরিণত হয়েছে। কার্পেটিং উঠে গিয়ে রাস্তার বড় বড় গর্তের কারণে যানবাহন চলাচল তো দূরের কথা, পায়ে হেঁটে চলাফেরাও দুরূহ হয়ে পড়েছে।
ভাটার দূষিত ধোঁয়ার প্রভাবে এলাকার ঘরে ঘরে শিশু ও বয়স্করা সর্দি-কাশি, হাঁপানি এবং চর্মরোগে ভুগছেন। তবে ইটভাটার মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো অভিযোগ করতে সাহস পান না।
রায়বালা গ্রামের ষাটোর্ধ্ব ছত্তার সিকদার বলেন, “এই গ্রাম একসময় গাছপালায় ভরপুর ছিল। এখানকার জমিতে তিন ফসল ফলত। কিন্তু ইটভাটার কারণে সব শেষ হয়ে গেছে। এখন আর আউশ ও রবি ফসল ফলানো সম্ভব হয় না। ভাটা মালিকদের কিছু বলতে গেলেই মামলা দিয়ে হয়রানি করার হুমকি দেওয়া হয়।”
একই গ্রামের ফরিদা বেগম জানান, “ইটভাটার ময়লার কারণে আমাদের বিছানা, কাঁথা-বালিশ সব ধুলায় ভরে যায়। আগের মতো নারকেল, আম, কাঁঠাল আর ধরে না। অনেক গাছ ইতোমধ্যেই মরে গেছে।”
খাগদান গ্রামের বাসিন্দা বাচ্চু হাওলাদার বলেন, “আমাদের বাড়ির গাছে আগে প্রচুর আম, জাম, কাঁঠাল, আর নারকেল হতো। কিন্তু ইটভাটা হওয়ার পর থেকে গাছগুলোতে তেমন ফল ধরে না।”
খাগদান গ্রামের ইউপি সদস্য মাসুম এবং রায়বালা গ্রামের ইউপি সদস্য জাকির হোসেন অভিযোগ করে বলেন, “আইনের কোনো তোয়াক্কা না করেই একের পর এক ইটভাটা গড়ে তোলা হচ্ছে। এসব ভাটায় ফসলি জমির মাটি এবং গাছ পোড়ানো হচ্ছে। ধুলাবালির কারণে পুরো এলাকা একাকার হয়ে যায়। জরুরি ভিত্তিতে এসব ভাটা বন্ধ করা প্রয়োজন।”
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর বরগুনার সহকারী পরিচালক হায়াত মাহমুদ রকিব বলেন, “আমি বরগুনায় নতুন যোগদান করেছি। বিষয়টি তদন্ত করে দেখব।”
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আশরাফুল আলম বলেন, “কৃষিজমি এবং জনগুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার পাশে ইটভাটা স্থাপন সম্পূর্ণ অবৈধ। এ বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত করে অভিযোগ প্রমাণিত হলে লাইসেন্স বাতিলের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ করা হবে।”